মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৫ অক্টোবর : সংক্রমণ বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে! প্রতিদিন গড়ে ৩৫০০ জন করে সংক্রমিত হয়েছে গত সপ্তাহে। বর্তমান সপ্তাহে, তা ৩৬০০’র ওপরে। ১৪ অক্টোবর, বুধবার রাজ্যে করোনা সংক্রমিত হয়েছেন ৩৬৭৭ জন! মৃত্যু হয়েছে ৬৪ জনের। পুজোর সময়ে এবং তারপরে সংক্রমণ আরো বাড়বে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এই পরিস্থিতিতে পুজো পালনের ক্ষেত্রেও নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, রাজ্য সরকারের তরফে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী পুজো উদ্বোধন করছেন, নবান্ন থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে। এর মধ্যেই, করোনা মোকাবিলায় আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর। কোভিড মোকাবিলায় বা করোনা পরিস্থিতির নজরদারিতে, দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদ তৈরি করা হয়েছে। এই পদ দুটি সম্পূর্ণভাবে, স্বাস্থ্য বিষয়ক। দায়িত্বে রাখা হয়েছে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদেরই। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই চিকিৎসকেরা প্রত্যেকেই মেডিসিন (Medicine) বিভাগের বিশেষজ্ঞ। স্বাভাবিকভাবেই, এই বিশেষজ্ঞরা যাতে কোভিড ১৯ বা করোনা চিকিৎসা পরিষেবায় সরাসরি নিয়োজিত থেকে, পরিষেবা আরো ত্রুটিমুক্ত হতে সহায়তা করতে পারেন, সেই জন্যই এই উদ্যোগ বলে জানা গেছে। এই নতুন পদ দুটি হল যথাক্রমে, ‘ক্লিনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর’ (Clinical Coordinator) এবং প্রটোকল সুপারভাইজার (Protocol Supervisor)। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ক্ষেত্রে, ক্লিনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর এর দায়িত্ব পেয়েছেন, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক (Professor) ডাঃ কৃপাসিন্ধু গাঁতাইত। তিনি সরাসরি জেলার করোনা চিকিৎসার ক্ষেত্রে, করোনা হাসপাতাল ও সেফ হোম গুলির পরিষেবা ও চিকিৎসা পদ্ধতি বিষয়ে সমন্বয় সাধন ও পরামর্শ দানের কাজ করবেন। জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিকবৃন্দ, মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা ক্রমে তিনি এই সমন্বয় সাধনের কাজ চালিয়ে যাবেন। অপরদিকে, প্রতিটি জেলার জন্য দু’জন করে বিশেষজ্ঞ মেডিসিন চিকিৎসক’কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, প্রোটোকল সুপারভাইজারের। ক্লিনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর’রা জেলার করোনা পরিষেবার খুঁটিনাটি বিষয় রিপোর্ট দেবেন বা আলোচনা করবেন এই প্রটোকল সুপারভাইজারদের সাথে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ক্ষেত্রে, এই দায়িত্বে আছেন, এন আর এসের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুব্রত পাল এবং আর.জি কর মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ টি.কে বিশ্বাস। পূর্ব মেদিনীপুরের ক্ষেত্রে, ক্লিনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক তথা Associate Professor ডাঃ বিকাশ শেঠ’কে। তবে তিনি নিজেই করোনা সংক্রমিত হওয়ার কারণে, এই মুহূর্তে দায়িত্ব নিতে পারবেন না বলে জানা গেছে, মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে। সেক্ষেত্রে বিকল্প ভাবা হচ্ছে বলেও জানা গেছে। পূর্ব মেদিনীপুরের প্রোটোকল সুপারভাইজারের দায়িত্বে আছেন যথাক্রমে, ডাঃ দোলন মোদক (এসটিএম) ও ডাঃ অতনু চন্দ্র (আর.জি.কর মেডিক্যাল কলেজ)। অপরদিকে, ঝাড়গ্রাম জেলাতেও সংক্রমণ ক্রমেই বাড়তে থাকলেও (৪৮ জন সংক্রমিত ১৪ অক্টোবরের বুলেটিনে), এই জেলার ক্ষেত্রে এরকম কোন পদ সৃষ্টি করা হয়নি!
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য ভবন। ইতিমধ্যে সেই নির্দেশিকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রতিটি জেলায়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ নিমাই চন্দ্র মন্ডল এবং উপ মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (১) ডাঃ সৌম্যশঙ্কর সারেঙ্গী জানিয়েছেন, এই ধরনের নির্দেশিকা এসে পৌঁছেছে। ইতিমধ্যে, সেই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। একই কথা জানিয়েছেন, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ পঞ্চানন কুন্ডু এবং ক্লিনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর এর দায়িত্ব প্রাপ্ত চিকিৎসক ডাঃ কৃপাসিন্ধু গাঁতাইত। নির্দেশিকা অনুযায়ী, ক্লিনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর সংশ্লিষ্ট জেলার মেডিক্যাল কলেজ, স্বাস্থ্য ভবন এবং করোনা হাসপাতাল গুলির মধ্যে সমন্বয় রাখবেন, যা কোভিড পরিষেবার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করবেন, জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ও উপ মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক বৃন্দ, মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও সুপার এবং করোনা হাসপাতালের সুপার ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে একটি কোভিড ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ তৈরি করে নিয়মিতভাবে আলোচনা করবেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দান করবেন। সর্বোপরি, তিনি লেভেল ফোর (করোনা হাসপাতালের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পরিষেবা যুক্ত) করোনা হাসপাতালের সিসিইউ (Critical Care Unit) বা আইসিসিইউ (Intensive Critical Care Unit) এবং এইচডিইউ (High Dependency Unit) তে ভর্তি থাকা রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন এবং প্রয়োজনী অনুযায়ী সশরীরে উপস্থিত থাকবেন। এছাড়াও, সেফ হোম গুলির ক্ষেত্রেও তাঁর দায়িত্ব থাকবে। এই বিষয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার উপ মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ সৌম্যশঙ্কর সারেঙ্গী জানিয়েছেন, “ডাঃ কৃপাসিন্ধু গাঁতাইত ক্লিনিক্যাল কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। CME বা একটি কোভিড ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে আধিকারিকরা ছাড়াও কোভিড হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সরাও থাকবেন। থাকবেন, রাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসরাও। সেখানে প্রয়োজনীয় আলোচনা বা পরামর্শ দান করা হবে। করোনা চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে বিষয়টি ইতিবাচক হবে বলেই আমরা মনে করছি। ইতিমধ্যে, শালবনী করোনা হাসপাতালে ডাঃ গাঁতাইত একবার পরিদর্শনেও গিয়েছিলেন। আর এবার থেকে তিনি সরাসরি যুক্ত থাকবেন চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে।” মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ পঞ্চানন কুন্ডু জানিয়েছেন, “এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে এই সমন্বয় সাধনের অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছি।” অন্যদিকে, দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক তথা আইএমএ (Indian Medical Association)’র মেদিনীপুর শাখার সম্পাদক ডাঃ কৃপাসিন্ধু গাঁতাইত জানিয়েছেন, “এই জেলাতে করোনা চিকিৎসা পরিষেবা এখন ঠিকঠাকই আছে। মৃত্যুর হার অনেক কম। তবে, ডেথ রেট বা মৃত্যুর হার আরও কমিয়ে, ক্রিটিক্যাল রোগীদেরও সুস্থ করে বাড়ি পাঠানোর জন্যই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য, আমরা সকলে মিলে একটা গ্রুপ করে নিচ্ছি। সেখানে প্রয়োজনীয় আলোচনা করা হবে। মূলত, ক্রিটিক্যাল বা সংকটজনক রোগীদের অর্থাৎ CCU এবং HDU রোগীদের আরো সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।” পূর্ব মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানিয়েছেন, “পূর্ব মেদিনীপুরের দায়িত্ব ডাঃ বিকাশ শেঠ’কে দেওয়া হলেও, তিনি করোনা সংক্রমিত হয়ে পড়েছেন! আমরা তাই এই বিষয় নিয়ে রাজ্যের সাথে আলোচনা করছি, পূর্ব মেদিনীপুরেরই কোন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কে এই দায়িত্ব দেওয়া যায় কিনা। ঝাড়গ্রাম জেলার ক্ষেত্রে এখনো কোনো নির্দেশ আমরাও পাইনি।”