মণিরাজ ঘোষ, শালবনী ও কেশপুর, ১৩ সেপ্টেম্বর : পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর থানার সিভিক পুলিশ (সিভিক ভলেন্টিয়ার) মদন চৌধুরী (৩৪)। বাড়ি কেশপুর থানার ঘোষপুকুরে। গত ৮ সেপ্টেম্বর করোনা রিপোর্ট পজিটিভ এসেছিল তাঁর। ৯ সেপ্টেম্বর থেকে চিকিৎসাধীন ছিলেন লেভেল ফোর শালবনী করোনা হাসপাতালে। মাত্র চারদিনের মধ্যে করোনা মুক্ত এবং সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে আজ (১৩ সেপ্টেম্বর) কিছুক্ষণ আগেই নিজের বাড়িতে ফিরলেন। দ্য বেঙ্গল পোস্টের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ তথা করোনাতঙ্কিত জেলাবাসীকে শোনালেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা।
করোনা যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই, একজন যোদ্ধা হিসেবে, সিভিক ভলেন্টিয়ার মদন ও তাঁর সহকর্মীদের সামাজিক পরিষেবা দিতে হয়েছে। ব্যাঙ্ক, বাজার, রাস্তাঘাট সর্বত্র ডিউটি করার সাথে সাথে, ডিউটি করতে হয়েছে, কনটেইনমেন্ট জোনগুলিতেও। সেই কারণে কিংবা সংক্রমণ রীতিমতো চার পাশেই প্রভাব বিস্তার করার ফলে, সিভিক পুলিশ মদন’কেও সংক্রমিত হতে হয়েছে। তিনি নিজেই জানালেন, “বেশ কয়েকদিন জ্বর ছিল, তাই থানা থেকেই র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ৮ তারিখ রাতে রিপোর্ট পজিটিভ আসে।” এরপর তাঁকে বলা হয়, বাড়িতে থাকতে পারেন, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু, বাড়িতে উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় এবং থানার পুলিশ অফিসারদের পরামর্শে ৯ সেপ্টেম্বর তিনি শালবনী করোনা হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হন। শালবনীতে ভর্তি হবেন জেনে, বন্ধুবান্ধব থেকে পাড়া-প্রতিবেশীরা অনেকেই তাঁকে ভয় দেখিয়ে বলেছিল,”শালবনীতে ভর্তি হবি ? মরেছে! ওখানে যা পরিষেবা, আরো অসুস্থ হয়ে যাবি! কি সব যেন ভিডিও ভাইরাল হয়েছে!” এসব শুনে প্রথমটাতে পুলিশকর্মী মদনও ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, বললেন, “একবার ভেবেওছিলাম, যাব?” তারপর, ‘ঠাকুর নাম’ করতে করতে শালবনীতে পৌঁছে গেলেন ৯ সেপ্টেম্বর দুপুর নাগাদ। মদন জানালেন, “প্রথম থেকেই স্বাস্থ্যকর্মী এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের ব্যবস্থাপনা বা পরিষেবাতে আশ্বস্ত হই। আমাকে থার্ড ফ্লোরের যে মাইল্ড সিমটোম্যাটিক (Mild Symptomatic) ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল, সেখানে সব মিলিয়ে ১৫-১৬ জন ছিলাম। ফ্যান, লাইট, পানীয় জল ও শৌচাগার কোন কিছুরই অসুবিধা ছিল না। প্রতিদিন একবার-দু’বার করে ওয়ার্ড এবং শৌচাগার পরিষ্কার করা হচ্ছিল।” সবথেকে বড় যে বিষয়টি নিয়ে, সারা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা এখন উত্তাল, তা হল শালবনী করোনা হাসপাতালে রোগীদের কাছে আসেন না চিকিৎসকেরা, এমনকি নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীরাও নাকি এক-দু’বার এসেই দায় সারেন; তারপর, বহু ডাকাডাকি করলেও দেখা পাওয়া যায় না! সেই সমস্ত আলোচনা বা ভিত্তিহীন গল্পে জল ঢেলে দিয়ে মদন বাবু আমাদের বললেন, “বাকি ওয়ার্ড আমি ঘুরে ঘুরে দেখিনি ঠিকই, অন্তত আমাদের স্বল্প উপসর্গযুক্তদের ওয়ার্ডে আমরা যে ১৫-১৬ জন কিছু বেশিজন ভর্তি ছিলাম, প্রথম দিন থেকে যে পরিষেবা পেয়েছি তাতে মুগ্ধ এবং নিশ্চিন্ত। শুধু আমি নই, আজকে আমি ছাড়াও আমাদের ওয়ার্ড থেকে মোট ৬ জন করোনামুক্ত হয়ে ছুটি পেয়েছি, সেই ৬ জন এবং ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা প্রত্যেককে আপনারা জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন, প্রত্যেকে একই কথা বলবে। প্রতিটি শয্যা বা বেডের কাছে সুইচ দেওয়া আছে, তা টিপলেই সিস্টার দিদিরা পৌঁছে যান। ওষুধ এবং খাওয়ার দাওয়ার সঠিক সময়ে পৌঁছে যেত। খাওয়ার দাওয়ারের মান যথেষ্ট ভালো। এছাড়াও, প্রতিটি শয্যার জন্য অক্সিজেনের ব্যবস্থা আছে। অক্সিজেনের কোন অভাব বা ঘাটতি লক্ষ্য করলাম না শালবনী করোনা হাসপাতলে। আমাদের ওয়ার্ডেই দু-তিনজন বয়স্ক মানুষকে অক্সিজেন দিতে হয়েছে। উপযুক্ত ফ্যান বা পাখার ব্যবস্থাও আছে।” কাজেই, অক্সিজেনের অভাব নিয়ে ওয়াকিবহাল মহল বা জেলার সমাজ সচেতন নাগরিকরা বেশ কিছুদিন ধরে যে প্রশ্ন তুলেছিলেন, সেই উত্তরও পাওয়া গেল, করোনা জয়ী ও যোদ্ধা মদন চৌধুরী’র কাছ থেকে। গত শুক্রবার (১১ সেপ্টেম্বর), দ্য বেঙ্গল পোস্ট’কে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ নিমাই চন্দ্র মন্ডল জানিয়েছিলেন, “শালবনীতে আগে ১৪০ টি মতো বেডে অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকলেও, বর্তমানে ২০০ টি বেডেই সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। সর্বোপরি, অন্যান্য যে কয়েকটি বিষয়ে কিছু সমস্যা ছিল, সেগুলির বিষয়েও পদক্ষেপ করা হয়েছে।” মেদিনীপুর ও খড়্গপুর শহর সহ জেলার বিভিন্ন এলাকার বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ গত কয়েক সপ্তাহে শালবনীতে মারা যাওয়ার পর, হাসপাতালের পরিষেবা এবং অক্সিজেন ব্যবস্থা নিয়ে জেলার উপ মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনিও জানিয়েছিলেন, “আমরা দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, প্রথম দিন থেকেই শালবনীতে অক্সিজেন ও ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তবে, এরকম কিছু ঘটনা হয়তো ঘটেছে, রোগী সেই সুযোগ টুকুও দেয়নি। তবে, অন্যান্য পরিষেবার বিষয়ে যদি কোনো প্রশ্ন উঠে থাকে, সেই বিষয়টিও সমাধানের জন্য জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দপ্তর তৎপর।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তুলনায় স্বল্প উপসর্গযুক্তদের চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে, প্রথম থেকেই কোন সমস্যা না থাকলেও, আশঙ্কাজনক বা বেশি উপসর্গযুক্তদের চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার এবং এখনো উঠছে। সেই বিষয়টি নিয়েও উদ্যোগী হয়েছে জেলা প্রশাসন ও জেলা স্বাস্থ্য দপ্তর।
***আরো পড়ুন:শালবনী করোনা হাসপাতালের সমস্ত বেডে অক্সিজেন…
এদিকে, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকায় এবং একটি ভিডিও গুজব ছড়িয়ে পড়ায়, জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বয়ং জেলাশাসক ডঃ রশ্মি কমল। তিনি বলেছেন, “নিরাপত্তা আরো জোরদার করতেই, ওই হাসপাতলে কিছু সিসি ক্যামেরা বসানো হচ্ছে।” তবে, তার আগেই করোনা মুক্ত মদন চৌধুরী’র অভিজ্ঞতার বর্ণনা, জেলা প্রশাসন তথা জেলা স্বাস্থ্য ভবনকে যে অনেকখানি স্বস্তি দান করবে, তা বলাই বাহুল্য! দ্য বেঙ্গল পোস্টের পক্ষ থেকে মদন বাবু’র কাছে “প্লাজমা দান” করার বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে জরুরী পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত এই সাহসী যোদ্ধা জানালেন, “আমাদের এলাকার একজন ক্যান্সার রোগী’কে একটা সময় তিন মাসে একবার করেও রক্ত দান করেছি। তখন, কেশপুর কলেজে পড়তাম। সেই ক্যান্সার আক্রান্ত অবশ্য এখন আর জীবিত নেই! এদিকে, বছরখানেক হলো আমার থাইরয়েড ধরা পড়েছে। জানিনা, রক্ত দান করা যাবে কি না! তবে, যদি দেওয়া যায় আমি রাজী।” এই মুহূর্তে কোনো শারীরিক অসুবিধা আছে কিনা, জানতে চাওয়া হলে মদন বললেন, “একটু দুর্বল ভাব আছে। তবে, আর কোনো অসুবিধা নেই।” আপাতত করোনা মুক্ত কেশপুরের মদন চৌধুরী ফের একবার করোনা যুদ্ধে সামিল হওয়ার জন্য প্রস্তুত, তার আগে হয়তো দিন কয়েকের বিশ্রাম। তার আগে, নিজের এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে, আতঙ্কিত জেলাবাসীকে অনেকখানি আশ্বস্ত করতে পারলেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
***আরো পড়ুন:করোনা সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে মেদিনীপুর! সংক্রমিত ৪৫, জেলায় ১৬৩, তালিকায় পুলিশ, স্বাস্থ্যকর্মী থেকে রাজনৈতিক নেতা…