কলকাতা ছাড়িয়ে জঙ্গলমহলে প্রবেশ করল “ব্ল্যাক ফাঙ্গাস”! ৩ জন আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া গেল, স্বাস্থ্য দপ্তরের নির্দেশিকা মেনে চলছে চিকিৎসা

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, বাঁকুড়া, ২৩ মে: কলকাতা ছাড়িয়ে এবার জঙ্গলমহলে আছড়ে পড়ল ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কৃষ্ণ ছত্রাক (মিউকরমাইকোসিস/Mucormycosis) এর ঢেউ! ইতিমধ্যেই যাকে নতুন “মহামারী” (Epidemic) ঘোষণা করেছে কেন্দ্র সরকার। শনিবার কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত করোনা হাসপাতালে মাত্র ৩২ বছরের এক গৃহবধূ প্রাণ হারিয়েছেন এই মারণ-ছত্রাক ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের প্রকোপে। আর, শনিবার রাতেই খবর পাওয়া গেল, জঙ্গলমহল বাঁকুড়া জেলার বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন ১ মহিলা সহ ৩ জনের শরীরে পাওয়া গেছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের উপসর্গ। সূত্রের খবর অনুযায়ী, ইতিমধ্যে পরীক্ষার মাধ্যমে ২ জনের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা নিশ্চিত হয়ে গেছেন ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের বিষয়ে। অপরজনের রিপোর্ট রবিবারই চলে আসবে বলে জানা গেছে। তবে, স্বাস্থ্য দপ্তরের নির্দেশিকা অনুযায়ী ৩ জনেরই চিকিৎসা শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, করোনা আক্রান্ত হয়ে ২ জন আগেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। অপর একজনের চিকিত্‍সা চলছিল বাড়িতেই। এও জানা গেছে, আক্রান্তদের মধ্যে ২ জনের বাড়ি বাঁকুড়ায়। অন্যদিকে, যে মহিলার শরীরে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের উপসর্গ দেখা দিয়েছে, তিনি পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোলের বাসিন্দা। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, করোনা চিকিত্‍সা চলাকালীনই ওই তিন জনের শরীরে ঢুকে পড়ে মারণ ছত্রাক!

thebengalpost.in
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস (ছবি- সংগৃহীত) :

মোবাইলে খবর পেতে জয়েন করুন
Whatsapp Group এ

এদিকে, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত এবং বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন এক রোগীর ভাই জানিয়েছেন, দাদা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। পরে সেরেও যায়। তারপর গত তিন চার দিন ধরে দাদার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা শুরু হয়। আর, সেকারণেই বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করা হলে, চিকিৎসকরা সমস্ত ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানান। অপরদিকে, বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডাঃ পার্থপ্রতীম প্রধান জানিয়েছেন, তিন জনের পরীক্ষা হয়েছিল, দু’জনের পরীক্ষার রিপোর্ট মিলেছে। প্রত্যেকের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা চলছে। তবে, এই ঘটনার পর আতঙ্ক ছড়িয়েছে নিঃসন্দেহে! বাঁকুড়া পুরসভার প্রশাসক মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য দিলীপ আগরওয়াল একটি সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, “শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের এক বাসিন্দা সম্প্রতি বেলঘরিয়া থেকে বাড়িতে আসেন। তিনি অসুস্থ হলে কোভিড টেস্ট করা হয়। রিপোর্ট পজিটিভ আসে। পরে হাসপাতালে আরো পরীক্ষার পরে তাঁর মাথায় ব্ল্যাক ফাঙ্গাস মেলে।” এই ঘটনার পর সরকারী উদ্যোগে চিকিৎসা শুরু হয়েছে। কলকাতা থেকে বিশেষ এক ধরণের ইঞ্জেকশান আনা হচ্ছে বলে তিনি জানান। অন্যদিকে, কলকাতার হরিদেবপুরের বছর ৩২ এর গৃহবধূ’কে গাইডলাইন অনুযায়ী ‘অ্যাম্পোটিরিসিন বি’ দেওয়া হয়েছিল। তা সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হয়নি! শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে শুক্রবার তাঁর মৃত্যু হয়। এও জানা গেছে, গোটা রাজ্যে এই মুহূর্তে মোট ১০ জন ব্ল্যাক ফাঙ্গাস আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা চলছে (সরকারিভাবে)।

thebengalpost.in
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস (ছবি- সংগৃহীত) :

অপরদিকে, বাঁকুড়ার ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর প্রতিটি জেলার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই নতুন করে চাঞ্চল্য ও তৎপরতা শুরু হয়েছে। অপরদিকে, রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর চরম সতর্কবার্তা দেওয়ার সাথে সাথে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা জারি করেছে। নির্দেশিকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রতিটি জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরে তথা আধিকারিকদের কাছে। এই নির্দেশিকা অনুযায়ী—“মিউকরমাইকোসিস” (Mucormycosis) বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস (Black Fungus) হল: পরিবেশে বসবাসকারী একটি ছত্রাক জনিত রোগ। সাধারণত কেউ এতে আক্রান্ত হয়না। অন্য কোনো অসুখের জন্য চিকিৎসা নিচ্ছেন এমন কিছু রোগীর দেহে যখন পরিবেশে ছড়িয়ে থাকা নানান রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, তখন তাঁর দেহে এই ছত্রাক বাসা বাঁধতে পারে। এই রোগের লক্ষণ ও উপসর্গগুলি হল :
• চোখ বা নাকের পাশে ব্যাথা ও লাল হয়ে যাওয়া
• জ্বর
• মাথায় যন্ত্রনা
• কাশি
• নিঃশ্বাসের কষ্ট
• রক্তবমি
• মানসিক অবস্থার পরিবর্তন।

thebengalpost.in
রাজ্য সরকারের গাইডলাইন :

রাজ্য সরকারের নির্দেশিকা অনুযায়ী, এই ‘ছত্রাক’ (Fungus) দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা—
• অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে।
• স্টেরয়েড ব্যবহারের ফলে, ইমিউনোসাপ্রেসন বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে।
• ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে বা ICU তে দীর্ঘদিন ভর্তি থাকলে।
• অঙ্গ প্রতিস্থাপন এর পরে/ ক্যানসার জাতীয় কো মর্বিডিটি থাকলে।
• ভরিকোনাজল থেরাপি হলে।
রাজ্য সরকারের গাইডলাইন অনুযায়ী এই রোগের প্রতিরোধে রা করতে হবে—
• ডায়াবেটিস রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, নিয়মিত ব্লাড সুগার মাপা ও ওষুধ নেওয়ার মাধ্যমে।
• সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। মাস্ক ব্যবহার এর ক্ষেত্রে কোনো শিথিলতা মেনে নেওয়া যাবে না বিশেষ করে নির্মাণ কাজ এর এলাকায়।
• সার-মাটি ইত্যাদি ব্যবহার করে বাগান করা জাতীয় কাজের সময় ফুল প্যান্ট, ফুল হাতা জামা, ঢাকা জুতো, গ্লাভস বা দস্তানা ব্যবহার করা দরকার।
• ব্যক্তিগত হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, ঘষে ঘষে ময়লা পরিষ্কার করে স্নান করতে হবে।
• আশেপাশের পরিবেশকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এমনভাবে যে যাতে কোনোমতেই পচে যাওয়া অর্গানিক জৈব পদার্থ যেমন পাউরুটির টুকরো, ফল, শাকসবজি, কম্পোস্ট, মলমূত্র ইত্যাদির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা যায়।
স্বাস্থ্যকর্মী/ চিকিৎসকদের যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে—
• স্টেরয়েড ব্যবহার যাতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় সঠিক দিন ধরে ব্যবহার করা;
• অক্সিজেন থেরাপির সময় হিউমিডিফায়ার বোতলে ডিস্টিলড ওয়াটার বা পরিশ্রুত জল ব্যবহার করা।
স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসকেরা কখন বুঝবেন রোগীর এই রোগে আক্রান্ত—
• সাইনুসাইটিস- নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, নাক থেকে কালো/ লালচে ক্ষরণ, হনুর হাড়ের ওপর ব্যথা।
• মুখের এক পাশে ব্যথা, অসাড় হয়ে যাওয়া, ফুলে ওঠা, মুখের ভেতর তালুতে/ নাকের গোড়ায় কালচে ভাব।
• দাঁতে ব্যথা, দাঁত আলগা হয়ে আসা।
• চোখে ব্যথা, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, দুটো করে দেখা।
• জ্বর, ত্বকে দাগ- এসচার।
• বুকে ব্যথা, ফুসফুসের আচ্ছাদনে জল জমা, রক্ত-কাশি, শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা উপসর্গ বেড়ে যাওয়া।

thebengalpost.in
রাজ্য সরকারের গাইডলাইন :

স্বাস্থ্যকর্মী/চিকিৎসকদের যেগুলি করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে—
• পোস্ট কোভিভ ও ডায়াবেটিকদের ব্লাড গ্লুকোজ এর মাত্রা মনিটর করা।
• বিপদ সঙ্কেত চিহ্নিত করার জন্য নিয়মিত চেকআপ।
• নিয়মনিষ্ঠভাবে এন্টিবায়টিক/ এন্টিফাঙ্গালের ব্যবহার।
যেগুলি না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে—
• নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া সব রুগীকে, বিশেষত কোভিভ রুগী/ ইমিউনো সাপ্রেসডদের সাইনুসাইটিস কে ব্যাকটেরিয়া জনিত বলে বিবেচনা না করা।
• ছত্রাক এর রকমসকম জানার জন্য জোরকদমে ইনভেস্টিগেশন করতে (KOH স্টেনিং, মাইক্রোস্কোপি, কালচার) ইতঃস্তত না করা।
• মিউকর মাইকোসিস এর চিকিৎসা শুরু করতে মূল্যবান সময় নষ্ট না করা।
যে ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করতে হবে:
• ডায়াবেটিস ও ডায়াবেটিক কিটোএসিডসিস এর কঠোর নিয়ন্ত্রণ।
• ধীরে ধীরে স্টেরয়েডের মাত্রা কমিয়ে তা বন্ধ করা।
• ইমিউনো মডুলেটোর ড্রাগ এর ব্যবহার বন্ধ করা।
• প্রোফাইল্যাক্সিস হিসেবে এন্টিফাঙ্গাল ব্যবহার করার দরকার নেই আগেভাগে।
• সার্জিক্যাল ডিব্রাইডমেন্ট বা শল্যচিকিৎসা করে সমস্ত নেক্রোটিক টিস্যু চেঁছে বাদ দেওয়া।
• এমফটেরিসিন বি ব্যবহার করে মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট।
• সেন্ট্রাল ক্যাথেটার (PICC line) লাগানো।
• কমপক্ষে চার থেকে ছয় সপ্তাহ এন্টিফাঙ্গাল ব্যবহার।
• রোগীকে নিয়মিতভাবে ক্লিনিক্যাল ও রেডিও ইমেজ এর মাধ্যমে মনিটরিং করা।
(তথ্য: রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের ২১ শে মে’র ব্ল্যাক ফাঙ্গাস গাইডলাইন। তথ্য বিশ্লেষণ: ডা: সমুদ্র সেনগুপ্ত, নন্দীগ্রাম স্বাস্থ্য জেলা, পূর্ব মেদিনীপুর।)

আরও পড়ুন -   'নির্দল কাঁটা' দূর হল অনেকটাই! প্রথম দফার ৬ আসনে ৩৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন পশ্চিম মেদিনীপুরে